স্বাস্থ্য সেবা অর্থায়ন কৌশলপত্র (২০১২-২০৩২) - এতে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ণ বৃদ্ধি ও তার অধিকতর সুষম ব্যবহারের একটি রুপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। এই কৌশলপত্রটি ২০১১-২০১৬ মেয়াদি স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচির (এইচটিএনএসডিপি) লক্ষ্য, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্য কর্মসূচির সার্বজনীন নীতিমালা এবং জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি ২০১১-র সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন। উল্লেখ্য, এসব নীতি ও কর্মসূচিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ণ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে।
আমরা জানি, মানুষের আয় ও আয়ুস্কাল বৃদ্ধির ফলে বার্ধক্যে পৌঁছা লোকের সংখ্যা বেড়েছে এবং এর সাথে যুক্ত হয়েছে জটিল (Chronic) রোগের ক্রমবর্ধমান বোঝা; ফলে দীর্ঘমেয়াদী এবং ব্যয়বহুল স্বাস্থ্য সেবার চাহিদা ক্রমেই বাড়ছে। একই সঙ্গে মানসম্পন্ন প্রতিরোধমূলক এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রয়োজন অব্যাহত রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে জনগণকে বিশেষ করে গরীব ও দু:স্থ শ্রেণীর জনগণকে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণকালে, বিশেষত: ব্যয়বহুল কোন রোগ চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিজ পকেট থেকে যে উচ্চ হারে অর্থব্যয় করতে হচ্ছে তার ফলে তাদের জীবনযাত্রায় বিপর্যয় ঘটছে। এই নেতিবাচক ও বিপর্যয়মূলক প্রভাব হ্রাস করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এই লক্ষ্যে স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণকালে সেবা গ্রহীতার আর্থিক সুরক্ষা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বস্তুত: স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ণ সংক্রান্ত এসব চ্যালেঞ্চসমূহ মোকাবেলা করার উদ্দেশ্যে এই কৌশলপত্রটি প্রনয়ণ করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য সেবার অর্থায়ণ সমস্যাঃ
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবার অর্থায়ণের চ্যালেঞ্জসমূহ বহুবিধ, এই কৌশলপত্রে সেগুলিকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলি হলোঃ
(১) স্বাস্থ্য খাতে সম্পদের স্বল্পতা;
(২) স্বাস্থ্য সেবায় অর্থবরাদ্দ ও ব্যবহারে অন্যায্যতা (Inequity) এবং
(৩) বরাদ্দকৃত সম্পদের ব্যবহারে অদক্ষতা।
প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, এই কৌশলপত্রে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অন্যান্য উপাদানগুলির (মানব সম্পদ, স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থাপনা, ঔষধ - সরঞ্জাম ইত্যাদির) গুরুত্বের কথা স্বীকার করা হয়েছে; তবে, সেই সব বিষয়ে এবং এই কৌশলপত্রের উপর সেগুলির প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়নি, কেননা এই কৌশলপত্র শুধু অর্থায়ণ বিষয়ে সীমিত।
কৌশলপত্র প্রণয়ন প্রক্রিয়াঃ
একটি ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই কৌশলপত্রটি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া পরিচালনা করেছে, হেলথ ফাইন্যাসিং রিসোর্স টাস্ক গ্রুপ - যার সভাপতি ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যান মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব। তিনটি টেকনিক্যাল ওয়াকিং গ্রুপ অর্থায়ণ সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জসমূহের ধারণাপত্রের খসড়াগুলি প্রস্তুত করে। এই সব গ্রুপে শিক্ষাবিদ, গবেষক, এনজিও এবং সরকারি প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বিভাগীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক কর্মশালাগুলিতে বিভিন্ন পর্যায়ের স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধিদের সম্মুখে প্রাথমিক খসড়াটি উপস্থাপন করে তাদের মতামত গ্রহন করা হয়। এসব মতামতের ভিত্তিতে পুন:খসড়াকৃত কৌশলপত্রটি জাতীয় পর্যায়ে কর্মশালা অনুষ্ঠান করে চুড়ান্ত করা হয়।
স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়ণের ক্ষেত্রে ইতোপূর্বে বর্ণিত চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবেলা ও স্বাস্থ্য সেবায় বরাদ্দ বৃদ্ধির জোরালো যুক্তি, সম্ভাব্য উপায় এবং একই সঙ্গে বাস্তবায়নযোগ্য একটি অর্থায়ন ব্যবস্থার রুপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে এই কৌশলপত্রে। সরকারি বরাদ্দ বৃদ্ধি, বেসরকারী ব্যয়কে আগাম প্রদান (Prepayment) ও একত্রীকরণ (Pooling) এর মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধি করা যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কৌশলপত্রে জনগোষ্ঠীর সকল অংশের আর্থিক সুরক্ষা সম্প্রসারণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
কৌশলপত্রের লক্ষ্যঃ
জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা অর্থায়ণ কৌশলপত্রের লক্ষ্য হলো আর্থিক সুরক্ষা জোরদার করণ: স্বাস্থ্য সেবা সম্প্রসারণের মাধ্যমে সেবা গ্রহণকারী জনগণের সংখ্যা বাড়ানো, বিশেষত: গরীব ও দুস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য এই সেবার সম্প্রসারণ। এই কৌশলপত্রের দীর্ঘ মেয়াদি লক্ষ্য হলো, সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা (Universal Health Coverage) নিশ্চিতকরণ। আরও নিদিষ্ট করে বলা হলে এই কৌশলপত্রের লক্ষ্য হলঃ
(১) সকল মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্মত ও কার্যকর স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া (রোগ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, চিকিৎসা এবং
পুনর্বাসন এর অন্তর্ভুক্ত); এবং
(২) এটা নিশ্চিত করা যে সেবা গ্রহণকারী এই সেবা গ্রহণের জন্য কোন আর্থিক দৈন্য-দশায় না পড়েন।
২০ বছর মেয়াদি এই স্বাস্থ্য অর্থায়ণ কৌশলপত্রে সরকারী বাজেট বরাদ্দ, প্রস্তাবিত সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি (যার মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠি এবং আনুষ্ঠানিক খাত অন্তর্ভূৃক্ত), বিদ্যমান কমিউনিটি ভিত্তিক ও অন্যান্য আগাম প্রদান স্কীম এবং দাতাগোষ্ঠী প্রদত্ত অর্থ সমন্বয়ের পরিকল্পনা করা হয়েছে- যাতে জনগোষ্ঠীর সকল অংশের স্বাস্থ্য সেবা গ্রহণজনিত ব্যয়ের বিপরীতে আর্থিক সুরক্ষা প্রদান নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। তবে এই ব্যবস্থা শুরু করা হবে প্রথমে হতদরিদ্রদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম দিয়ে।
এই কৌশলপত্রে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিকতর সংশ্লিষ্টতা এবং বলিষ্ঠ তত্ত্বাবধানের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়ণ বৃদ্ধিতে বেসরকারী খাতের (লাভ জনক ও অলাভজনক) পরিপূরক ভুমিকা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব এবং উন্নয়ন সহযোগিদের অব্যাহত সহায়তা বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
এই কৌশলপত্রে জনগণের সংশ্লিষ্টতা ও অংশগ্রহণ যাতে আরো ব্যাপক হয় সে লক্ষ্যে নিদিষ্ট কার্যক্রম অন্তর্ভূক্ত করা হবে।
কৌশলগত উদ্দেশ্যাবলী (Strategic Objectives):
স্বাস্থ্য সেবার আর্থিক চ্যালেঞ্জসমূহ মোকবিলা, সমগ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং সেবা গ্রহণকালে নিজ পকেট হতে নগদ ব্যয় (Out of Pocket Expenditure) কমানোর লক্ষ্যে নীচের তিনটি কৌশলগত উদ্দেশ্য (Strategic Objective) নির্ধারণ করা হয়েছে:
কৌশলগত পদক্ষেপ এবং এ সংক্রান্ত কর্মসূচিঃ
উপরে বর্ণিত কৌশলগত উদ্দেশ্যসমূহ বাস্তবায়নে কতগুলি পদক্ষেপ এই কৌশলপত্রে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছেঃ
১. সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা
এই কর্মসূচির অধীনে রয়েছে:
২. অর্থায়ণ এবং জনস্বাস্থ্য সেবাসমূহ জোরদার করা
এই কর্মসূচির অধীনে রয়েছে:
৩. জাতীয় পর্যায়ে সামর্থ্য বৃদ্ধি করা
এ কার্যক্রমের মধ্যে গৃহীতব্য পদক্ষেপগুলি হলো:
এই কৌশল বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের সমস্ত জনগোষ্ঠী সরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রাপ্তিতে অধিকতর আর্থিক সুরক্ষার আওতায় আসবেন।
কৌশলপত্রের বাস্তবায়ন মেয়াদ:
এই কৌশল স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘ - এই তিনটি মেয়াদে বাস্তবায়ন করা হবে। স্বল্প মেয়াদি পর্যায়টির স্থায়িত্বকাল হবে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচি কাল (২০১৬) অবধি। এই পর্যায়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির (SSK) পরীক্ষামূলক বাস্তবায়ন কাল (Piloting) শেষ হবে এবং জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তা অফিস (NHSO) এবং সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ন অংশসমূহ প্রণয়ন করা হবে। মধ্য মেয়াদি পর্যায়টির স্থায়িত্ব হবে ২০২১ সাল পর্যন্ত এবং এই পর্যায়ে পূর্ববর্তী পর্যায়ের (SSK, NHSO এবং সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রম ) কর্মসূচিসমূহ যথাযথভাবে সম্প্রসারিত করা হবে। দীর্ঘ মেয়াদি পর্যায়ে পরবর্তী ১১ বছরে বাংলাদেশ সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবার আওতায় আসবে বলে আশা করা যায়। এটি হবে স্বল্প ও মধ্য মেয়াদি পর্যায়ের অর্জিত সাফল্য এবং এই কৌশলপত্রে বর্ণিত পদক্ষেপসমূহের পর্যায়ক্রমিক প্রয়োগের ফলশ্রুতি।
বাস্তবায়ন পরিবীক্ষন (Monitoring) :
ব্যাপকভিত্তিক এই কৌশলপত্রটিতে অন্তর্ভূক্ত রয়েছে একটি যুক্তিসঙ্গত কাঠামো এবং একগুচ্ছ সূচক। এই বিশ্লেষণধর্মী কাঠামো এবং সূচকগুলি বর্ণিত উদ্দেশ্যের আলোকে বর্তমান চলমান এবং প্রস্তাবিত কার্যক্রমগুলির মূল্যায়ন করার কাজটি সহজ করবে।
বস্তুত: এই কৌশলপত্রে সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য অর্জনের উপায়সমূহের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো, সকল বাংলাদেশীর স্বাস্থ্য সেবা চাওয়ার ও পাওয়ার ক্ষেত্রে আর্থিক ঝুঁকি দূরীকরণের কার্যকর পদক্ষেপ সূচনা করা।
স্বাস্থ্য সেবা অর্থায়ন কৌশলপত্র ২০১২-২০৩২ সম্পর্কিত প্রেজেন্টেশন দেখতে এখানে ক্লিক করুন ।
স্বাস্থ্য সেবা অর্থায়ন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে নিম্নলিখিত ফাইলগুলি ডাউনলোড করুন: